প্রতিটি স্মার্টফোন চলার জন্য প্রয়োজন হয় বৈদ্যুতিক শক্তির। এবং স্মার্টফোনের এই শক্তির উৎস হচ্ছে ব্যাটারি। এটা তো আমরা সবাই জানি। কিন্তু স্মার্টফোনের ব্যাটারি সম্পর্কে আমাদের মধ্যে বেশ কিছু ভুল ধারণা রয়েছে। এমন কিছু বিষয় সম্পর্কে আমরা অবগত না যার ফলে আমরা আমাদের স্মার্টফোনের ব্যাটারির আয়ু খুব দ্রুত কমিয়ে ফেলছি। পাশাপাশি এমন কিছু তথ্য আপনাদের সাথে শেয়ার করব যা সম্পর্কে হয়তো আপনি জানতেন না বা জানলেও সঠিক তথ্য হয়তো জানতেন না।
তো আজকে আর্টিকেল এর মাধ্যমে আপনাদের স্মার্টফোনের ব্যাটারি সম্পর্কিত ভুল ধারনাগুলো কে ভাঙার চেষ্টা করব। পাশাপাশি এমন কিছু তথ্য জানাবো যা আপনার প্রত্যাহিক জীবনে অনেকটা কাজে লাগবে। সেটা অবশ্যই হবে স্মার্টফোনের ব্যাটারি সম্পর্কিত।
স্মার্টফোনের ব্যাটারি কিভাবে কাজ করে?
সবার আগে আমাদের জানতে হবে স্মার্টফোনের ব্যাটারি কি দিয়ে তৈরি হয় এবং কিভাবে কাজ করে। তো চলুন, স্মার্টফোনের ব্যাটারি কাজ করার প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা নেই
প্রায় সকল স্মার্টফোনে ব্যবহার করা হয় লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি। লিথিয়াম হল একটি রাসায়নিক পদার্থ এবং লিথিয়াম-আয়ন হলো লিথিয়াম পরমাণুর একটি আয়নিক রূপ। কোন পরমাণু যখন ইলেকট্রন গ্রহণ বা ত্যাগ করে তখন ওই পরমাণু আয়নে পরিণত হয়। লিথিয়াম এমন একটি পরমাণু যা খুব সহজেই ইলেকট্রন ত্যাগ ও গ্রহণ করতে পারে। এই কারণে ব্যাটারীতে লিথিয়াম ব্যবহার করা হয়। আমরা সবাই জানি একটি ব্যাটারির মধ্যে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক দুইটি প্রান্ত থাকে। যাকে আমরা প্লাস ও মাইনাস প্রান্ত নামে চিনি।
একটি ব্যাটারির ঋনাত্বক প্রান্ত থেকে ইলেকট্রন নির্গত হয় এবং সেটা পুরো সার্কিট এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পুনরায় ধনাত্মক প্রান্ত দিয়ে ব্যাটারিতে প্রবেশ করে। এই ইলেকট্রনের প্রবাহ বা বিদ্যুৎ প্রবাহের কারণেই একটি ডিভাইস সচল হয়। একটি ব্যাটারির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ থাকে। এই পদার্থগুলো ব্যাটারির সেলের মধ্যে আয়নিত অবস্থায় থাকে। যেমন লিথিয়াম আয়ন সেলের মধ্যে Li(-) আয়ন থাকে এবং অপরদিকে কোবাল্টের ধনাত্মক আয়ন(Co+) থাকে। এদের পরস্পরকে একে অপরের থেকে আলাদা আলাদা রাখে ইলেক্ট্রোলাইট।
সহজ ভাষায় বলতে গেলে লিথিয়াম পরমাণু থেকে ইলেকট্রন নির্গত হয় স্মার্টফোনের পুরো সার্কিট এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় পুনরায় ওই ব্যাটারির ধনাত্মক প্রান্ত অর্থাৎ কোবাল্টের আয়নে প্রবেশ করে। যখন আমরা ব্যাটারি রিচার্জ করি বা স্মার্টফোন চার্জ করি তখন এর বিপরীত প্রক্রিয়াটি ঘটে। অর্থাৎ তখন ইলেকট্রন পুনরায় লিথিয়াম এর পাশে চলে আসে। এভাবেই একটি লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি কাজ করে।
নতুন কেনা ফোন অতিরিক্ত সময় চার্জ দেওয়া
যখন আমরা নতুন কোনো স্মার্টফোন কিনি তখন সবার আগে যে কাজটি করি তা হল স্মার্টফোনটিকে সাত-আট ঘণ্টা ধরে চার্জে বসিয়ে রাখি। যেখানে স্মার্টফোনটি 1,2 ঘন্টায় ফুল চার্জ হয়ে যায়। আমাদের এই সাত-আট ঘণ্টা ফোন চার্জে লাগিয়ে রাখার ধারনাটা ভুল।
একটি স্মার্টফোন যখন ম্যানুফ্যাকচার হয় তখন সেটাকে 50 থেকে 60 পার্সেন্ট চার্জ করে বক্সে ঢুকানো হয়। কারণ লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি 50 থেকে 60 শতাংশ চার্জে থাকা অবস্থায় সবথেকে কম ব্যাটারি ব্যবহার করে। স্মার্টফোনের ব্যাটারি গুলো সাধারণত দুই থেকে তিন ঘন্টার মধ্যে ফুল চার্জ হয়ে যায়। সেখানে সাত-আট ঘণ্টা চার্জে লাগিয়ে রাখার কোনো প্রয়োজন হয় না। সে নতুন ফোন হলেও।
ব্যাটারির চার্জ 100% হওয়ার পর সর্বোচ্চ 10 থেকে 15 মিনিট লাগিয়ে রাখলেই যথেষ্ট সেখানে আরও চার থেকে পাঁচ ঘন্টা চার্জে লাগিয়ে রাখলে আপনার ব্যাটারি ক্যাপাসিটি বাড়বে না।
স্মার্টফোন সারারাত চার্জ দিলে কি সমস্যা হয়?
এই বেশিক্ষণ চার্জে লাগিয়ে রাখা নিয়ে আমাদের আরো একটি ভুল ধারণা রয়েছে। আমরা অনেকেই মনে করি সারারাত ফোন চার্জে লাগিয়ে রাখলে সেটা ব্যাটারির পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। আমাদের অনেকের মনেই এই প্রশ্ন ঘোরাফেরা করে যে সারারাত ফোন চার্জে লাগিয়ে রাখে কোন সমস্যা হবে কিনা। এর উত্তর হচ্ছে, না। কারণ বর্তমান সময়ে প্রায় সব ফোনের ওভারচার্জিং প্রোটেকশন থাকে। অর্থাৎ আপনার যদি ফুল চার্জ হওয়ার পরেও চার্জে লাগানো থাকে সে ক্ষেত্রে কোন ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
ফাস্ট চার্জিং কি ব্যাটারির জন্য ক্ষতিকর?
বর্তমান সময় দেখা যায় 15,000 টাকার ওপরে সব স্মার্টফোনেই ফাস্ট চার্জিং সিস্টেম দেওয়া থাকে। স্মার্টফোনের দাম অনুযায়ী ফাস্ট চার্জিং এর পাওয়ার কম বেশী হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের সকলের মনেই একটা প্রশ্ন যে, “ফাস্ট চার্জিং কি ব্যাটারির জন্য ক্ষতিকর?” আমরা অনেক জায়গায় শুনে থাকি ফাস্ট চার্জিং ব্যাটারি আয়ু কমিয়ে দেয়। কিন্তু এই ধারণাটি সঠিক নয়। এখনো পর্যন্ত একটি স্মার্টফোনও পাওয়া যায়নি যার ব্যাটারি ফাস্ট চার্জিং এর জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
প্রতিটি ব্যাটারি ক্যাপাসিটি স্বাভাবিকভাবেই ধীরে ধীরে কমতে থাকে। স্মার্টফোন কোম্পানি ফোন তৈরি করার সময় সবকিছু টেস্ট করে দেয়। সেক্ষেত্রে পরবর্তীকালেও সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
ডাবল ক্যাপাসিটি মানে ডাবল স্ক্রিন টাইম
আমরা অনেকেই মনে করি একটি স্মার্টফোনের ব্যাটারি যদি 4000mAh এবং অন্য একটি স্মার্টফোনের ব্যাটারি যদি 8000mAh হয়, তাহলে 8000mAh ব্যাটারির স্মার্টফোনটি 4000mAh এর তুলনায় দ্বিগুণ ব্যাটারি ব্যাকআপ বা স্ক্রিন অন টাইম দেবে। কিন্তু বাস্তবে তা কখনোই দেয়না। বাস্তবে দেখা যায় 4000mAh এর স্মার্টফোনটি যদি চার ঘন্টা ব্রেকআপ দেয় তাহলে 8000mAh স্মার্টফোনটিতে 6 ঘন্টা ব্যাকআপ দিবে।
যদিও স্মার্টফোনের ব্যাটারি ব্যাকআপ অনেক বিষয়ের উপর নির্ভর করে। যেমন নেটওয়ার্ক কন্ডিশন, ব্রাইটনেস লেভেল, টেম্পারেচার এবং সবশেষে ও সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল আপনি কতটুকু প্রেসার দিয়ে কাজ করছেন। গেমিং বা হেভি কোন এপ্লিকেশন রান করলে অবশ্যই ব্যাটারি অনেকটা খরচ হবে।
অনেক ক্ষেত্রে ব্যাটারি ব্যাকআপ ইউজার ইন্টারফেস এবং অপটিমাইজেশনের উপরে নির্ভর করে। ফোনের ui যদি ব্যাটারির পাওয়ার কে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে সে ক্ষেত্রে ক্যাপাসিটি অনুযায়ী বেশ ভালো ব্যাটারি ব্যাকআপ পাওয়া যাবে।
দামি বা ফ্লাগশিপ ফোনে কেন বেশি ব্যাটারি দেওয়া হয় না?
দামি বা ফ্লাগশিপ ফোন গুলোতে সাধারণত অনেক বেশি ফিচার দেওয়া হয়। এর জন্য স্মার্টফোনের ভিতরে বিশেষ বিশেষ সেন্সর বা আইসি দেওয়া হয়। এতে স্মার্টফোনের ভিতরে জায়গা অনেকটা কমে যায়। পাশাপাশি স্মার্টফোনটি পাতলা ও স্লিম রাখতে স্মার্টফোনের ব্যাটারি ছোট করতে হয়।
অনেক সময় আমরা মিড রেঞ্জের ফোনগুলোতে দেখি কম ব্যাটারি দেওয়া হয় এর মূল কারণ স্মার্টফোন দেখতে আরো স্লিম ও দেখতে সুন্দর করা। এই কারণেই মূলত কিছু স্মার্টফোনের ভিতরে কম ব্যাটারি দেওয়া হয়।
সর্বশেষে আপনার স্মার্টফোনের ব্যাটারি কে ভালো রাখতে কিছু স্মার্ট টিপস
- স্মার্ট ফোন অতিরিক্ত গরম থাকা অবস্থায় চার্জে লাগাবেন না।
- ব্যাটারি লেভেল 20% হওয়ার আগেই স্মার্টফোন চার্জে লাগাবেন।
- ফোনে 0% চার্জ থাকা অবস্থায় একদিনের বেশি ফেলে রাখবেন না। ব্যবহার না করলেও নিয়মিত চার্জ দিবেন।
- সব সময় চেষ্টা করবেন কোম্পানি থেকে ফোনের সাথে দেওয়া চার্জার দিয়ে চার্জ করতে। অথবা ভালো কোন ব্র্যান্ডের চার্জার ব্যবহার করতে পারেন।
- অপ্রয়োজনে পাওয়ার ব্যাংক দিয়ে চার্জ দিবেন না
তো এই ছিল স্মার্টফোনের ব্যাটারি নিয়ে আজকের এই ইনফরমেটিভ আর্টিকেল। আর্টিকেলে যদি আপনার কাছে হেল্পফুল মনে হয় সেক্ষেত্রে এই আর্টিকেলটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন। ধন্যবাদ।
2 thoughts on “স্মার্টফোনের ব্যাটারি সম্পর্কে যে ভুল ধারণাগুলো আপনাকে বিপদে ফেলতে পারে”