সেরা ক্যামেরা ফোন কেনার আগে যা যা জানা জরুরী

বর্তমান সময় স্মার্টফোনের ক্যামেরা স্পেকের দিক থেকে যেন ডিএসএলআর কেও যেন হার মানিয়ে দিচ্ছে। কেউ দিচ্ছে 108 মেগাপিক্সেল ক্যামেরা, আবার কেউ দিচ্ছি 120 এক্স জুম। কেউ দিচ্ছে অপটিক্যাল ইমেজ স্টাবিলিজেশন। কিন্তু সত্যিই কি এগুলো একটি ফোনকে ডিএসএলআর এর বিকল্প তৈরি করছে? নাকি এগুলো সবই গিমিক। সেটা নিয়েই থাকবে আজকের আর্টিকেল। পাশাপাশি আপনাদের জানানোর চেষ্টা করব সেরা ক্যামেরা ফোন কিনার আগে যে সব বিষয় মাথায় রাখবেন।

বর্তমান সময় ফটোগ্রাফি অনেকের আকর্ষণের বিষয়। কিন্তু সবার তো আর দামি ডিএসএলআর কেনার সামর্থ্য থাকে না। এক্ষেত্রে তারা স্মার্টফোনকে ডিএসএলআর ক্যামেরার বিকল্প হিসেবে কাজে লাগায়। অনেকে আবার আছেন যারা স্মার্টফোন দিয়ে ভিডিওগ্রাফি করেন। তো সেক্ষেত্রে একটি ফোনের ক্যামেরা বিভিন্ন কাজের জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বর্তমান সময়ে আমরা দেখতে পারি প্রতিটি ফোনেই একাধিক ক্যামেরা সেন্সর থাকে। স্মার্টফোন বাজারে তো প্রায় প্রতিযোগিতা চলছে কোন কোম্পানি কার থেকে বেশি সংখ্যক ক্যামেরা সেন্সর যুক্ত করতে পারে। দেখা যায় 10 হাজার টাকার ফোন তিনটি ক্যামেরা থাকে। বর্তমান সময়ে স্মার্টফোনে 4 টি ক্যামেরা ট্রেন্ড হয়ে গিয়েছে। দেখা যাবে হঠাৎ কোন কোম্পানি যদি একটি ক্যামেরাযুক্ত কোন ফোন লঞ্চ করে সেটা যতই ভাল রেজাল্ট করুক, বর্তমান যুগের সাথে বেমানান হয়ে যাবে। কিন্তু এতগুলো সেন্সর কি খুব প্রয়োজন?

ফোনের একাধিক ক্যামেরার প্রয়োজনীয়তা

আমরা দেখতে পাই, চারটি ক্যামেরার মধ্যে একটি থাকে প্রধান সেন্সর। যার মেগাপিক্সেল অন্যগুলোর তুলনায় বেশি হয়ে থাকে। কোনো কোনো ফোনে আমরা আল্ট্রা ওয়াইড ক্যামেরা দেখতে পাই। এটা অনেক সময় কার্যকরী হয়ে ওঠে। তবে এই ক্যামেরার রেজুলেশন সর্বোচ্চ 12 মেগাপিক্সেল পর্যন্ত যা একটি স্টান্ডার রেজুলেশন।

কিন্তু কোনো কোনো কোম্পানি 5 মেগাপিক্সেল বা 8 মেগাপিক্সেল এর আল্ট্রা ওয়াইড সেন্সর বসিয়ে দেয়। প্রথমত আল্ট্রা ওয়াইড ছবিতে অনেক বেশি পরিমাণে জায়গা কভার করে ক্যামেরার সেন্সর। সে ক্ষেত্রে রেজুলেশন কম হলে ছবিতে ডিটেইলের অনেকটা ঘাটতি দেখা যায়। ফলে এই 5 মেগাপিক্সেল বা 8 মেগাপিক্সেল এর আল্ট্রা ওয়াইড ক্যামেরা থেকে আশানুরূপ রেজাল্ট পাওয়া যাবে না এটাই স্বাভাবিক। রেজুলেশনের কথা একটু পরে বলছি,,,

এরপর আসে 2 মেগাপিক্সেল এর ম্যাক্রো ক্যামেরা এবং 2 মেগাপিক্সেল এর ডেপ্থ সেন্সর। ম্যাক্রো ক্যামেরা দিয়ে অনেক সময় বেশ ভালো কিছু ছবি তোলা সম্ভব। তবে ডিটেইলের ঘাটতি থেকেই যায়। কিন্তু এই 2 মেগাপিক্সেল এর বা 5 মেগাপিক্সেল এর ডেপ্থ সেন্সর দেওয়ার যুক্তিকতা আমি খুজে পাইনা। কোম্পানি দাবি করে সেন্সর নাকি পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এমন অনেক স্মার্টফোনে আছে যারা ডেপ্থ সেন্সর ছাড়াও বেশ ভালো মানের পোট্রেট ছবি তুলতে পারে। সে ক্ষেত্রে এই সেন্সর ব্যবহার যুক্তি হতে পারে ফোনের ক্যামেরা সংখ্যা বাড়ানো। এরপর থাকে টেলিফটো ও পেরিস্কপ জুম লেন্সের কথা। যেটা অনেকটা কার্যকর। তবে এই ফিচার শুধুমাত্র ফ্ল্যাগশিপ ফোনে পাওয়া যায়।

হাই রেজুলেশনের সাথে ক্যামেরা পারফরম্যান্স এর সম্পর্ক

সেরা ক্যামেরা ফোন এর হাই resolution ক্যামেরা

এখন আসি রেজুলেশনের কথায়। স্মার্টফোন কোম্পানি গুলো প্রতিযোগিতা করছে কে কার থেকে বেশি মেগাপিক্সেল এর ক্যামেরা সেন্সর দিতে পারে। আমরা দেখতে পাই 108 মেগাপিক্সেল ক্যামেরা এখন 25000 টাকার ফোনেও পাওয়া যায়। তিন থেকে চার বছর আগের কথা যখন ফোনে 12 মেগাপিক্সেল এর ক্যামেরায ছিল যথেষ্ট। এরপর আসে 12 থেকে 16, 24, 32। এরপর 48 মেগাপিক্সেল, এরপর ধীরে ধীরে কোম্পানিগুলো 48 থেকে 64 এবং এখনতো 108 মেগাপিক্সেল দিচ্ছে।

কিন্তু আসল কথা হচ্ছে ক্যামেরা পারফরমেন্সে কতটা উন্নতি হয়েছে। আমরা ক্যামেরার স্পেসিফিকেশনে যতটা উন্নতি দেখছি ক্যামেরার রেজাল্টে তেমন উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। কারণ তারা সফটওয়্যার নিয়ে খুব একটা কাজ করছে না। কিন্তু এই সফটওয়্যার বা অ্যালগরিদম একটি ক্যামেরার রেজাল্টে অনেক বড় পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। যেমনটা আমরা দেখতে পাই গুগলের পিক্সেল ফোন, অ্যাপলের আইফোন এর ক্ষেত্রে। তারা 12 মেগাপিক্সেল ক্যামেরা দিয়ে যা রেজাল্ট দিতে পারে তা অন্যান্য কোম্পানির 108 মেগাপিক্সেল দিতে পারেনা।

কিন্তু এমনটা কেন ঘটে?

এমনটা ঘটে, তার কারণ ক্যামেরা সফটওয়্যার এর অ্যালগরিদম বা ইমেজ প্রসেসিং অ্যালগরিদম। এছাড়া মেগাপিক্সেল যত বেশি হয় ক্যামেরা সেন্সর সাইজ সেই তুলনায় বড় হয় না। আসলে যা ঘটে, ওই একই সাইজের সেন্সর এর ভিতরেই বেশি পরিমাণে পিক্সেল ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ফলে পিক্সেল এর সাইজ ছোট হয়। অর্থাৎ পিক্সেল এর সাইজ যত ছোট হবে সেটা তত কম পরিমাণে আলো ক্যাপচার করতে পারবে।

আসল কথা হচ্ছে আপনি যত বেশি মেগাপিক্সেল ফোন ব্যবহার করেন না কেন ছবি তোলার সময় আপনার ফোন ওই 12 মেগাপিক্সেল এই ছবি তুলবে। কারণ ফুল মেগাপিক্সেল এর ছবি তুললে প্রথমত ছবির সাইজ অনেকটা বেড়ে যাবে। দ্বিতীয়ত ছবিটা ঠিক ভাবে প্রসেস করতে পারবে না। অর্থাৎ আপনি ভাল রেজাল্ট পাবেন না। এই বিষয়টি দেখা যায় যখন আমরা 48 মেগাপিক্সেল 64 মেগাপিক্সেল মুড এ ছবি তুলি। সেটা কখনোই নর্মাল মুড এর মত প্রসেসড হয় না।

কম আলোতে 48 মেগাপিক্সেল মুড এ ছবি তুললে ছবিতে নয়েজ পরিমাণ অনেকটা বেড়ে যায়। অনেক কোম্পানি আবার এমনও আছে যারা 12 মেগাপিক্সেল এর সেন্সর দিয়ে সেটাকে আপস্কেল করে 48 বা 64 মেগাপিক্সেল এর ছবি তৈরি করে। এবং আপনাকে 48 বা 64 মেগাপিক্সেল এর সেন্সর দিয়েছে বলে বোকা বানায়। এসবই চলছে বর্তমানে স্মার্টফোন ইন্ডাস্ট্রিতে।

মিড রেঞ্জের ফোনে আমরা চাইলেও 108 মেগাপিক্সেল এর পরিবর্তে 12 পিক্সেল এর ভালো সেন্সর পাবো না। কারণ স্মার্টফোন কোম্পানি জানে যে অধিকাংশ গ্রাহক এইসব বিষয়ে ভাবে না। তারা বড় বড় নাম্বার দেখেই স্মার্টফোন কেনে। কিন্তু কোন ফোনেই কি ক্যামেরা তে ভালো রেজাল্ট দেয় না? অ্যান্ড্রয়েডের জগতে গুগোল পিক্সেল ফোনের ক্যামেরাকে সেরা এবং অন্য অপারেটিং সিস্টেম এর ফোনগুলোর মধ্যে অ্যাপলের ক্যামেরা কে সেরা ধরা হয়। তবে বর্তমানে স্যামসাং অনেকটা উন্নতি করেছে এবং স্যামসাংয়ের লেটেস্ট s21 আল্ট্রা অনেক ক্ষেত্রে আইফোন 12 প্রো ম্যাক্সকেও কে হার মানিয়ে দিয়েছে।

কেন ১২ মেগালিক্সেল সেন্সর স্মার্টফোনের জন্য যথেষ্ট তা জানতে এই আর্টিকেলটি পড়ুন।

ক্যামেরা পারফরমেন্সের সাথে ইমেজ সেন্সর ও আইএসপি এর সম্পর্ক

image sensor

ফোনের ক্যামেরার পারফরম্যান্স আরো কয়েকটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। তার মধ্যে অন্যতম হলো ইমেজ সেন্সর এবং প্রসেসরে থাকা আইএসপি বা ইমেজ প্রসেসিং ইউনিট। এই নিয়ে বিস্তারিত আমাদের প্রসেসর সম্পর্কিত পোস্ট এ পেয়ে যাবেন।

আমরা বেশিরভাগ ফোনে দেখতে পাই সানির সেন্সর, স্যামসাং এর সেন্সর বা অমনিভিশন সেন্সর ব্যবহার করা হয়। সনির সেন্সরে তুলনামূলক ভালো ছবি পাওয়া যায় অন্যদের তুলনায় এবং অমনিভিশন এর সেন্সর গুলো বেশ সার্প ছবি দেয়। স্যামসাংয়ের সেন্সর এভারেজ রেজাল্ট দেয়। তো সে ক্ষেত্রে সেন্সরের উপরেও ক্যামেরার রেজাল্ট অনেকটা ডিপেন্ড করে।

একটি স্মার্টফোনের ক্যামেরা কখনোই ডিএসএলআর ক্যামেরার মত রেজাল্ট দিতে পারে না। কারণ এসএলআর ক্যামেরার সেন্সর অনেকটা বড় হয়। সেখানে সাধারণ স্মার্টফোনের ক্যামেরা সেন্সর তুলনামূলক অনেকটা ছোট হয়। সেন্সর যত বড় হবে ছবিতে নয়েজের পরিমাণ তত কমবে। কিন্তু বর্তমানে স্মার্টফোনে প্রায় ডিএসএলআর এর সমান বড় সেন্সর দেওয়ার চেষ্টা করছে। যেমন Mi11 Ultra তে 1inch সাইজের সেন্সর দেওয়া হয়েছে।

লো লাইটে ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে অ্যাপারচার এর গুরুত্ব

রাতের বেলায় ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে বড় সেন্সর যেমন গুরুত্বপূর্ণ ক্যামেরার অ্যাপারচার ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। এখন প্রশ্ন হলো এই অ্যাপারচার আবার কি? আপনারা হয়তো জানেন ক্যামেরা সেনসর উপর একাধিক লেন্স থাকে। অ্যাপারচার লেন্সের ভিতর দিয়ে যাওয়া লাইটের পরিমাণ কে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এ স্মার্টফোনের ক্যামেরা তে ফিক্সড অ্যাপারচার দেওয়া থাকে। অর্থাৎ এই অ্যাপারচার আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না।

kinds of apparture

ক্যামেরার অ্যাপারচার যত কম হবে লেন্স এর ভিতর দিয়ে ততো বেশি পরিমাণে আলো সেন্সরে প্রবেশ করতে পারবে। আমরা ফোনের স্পেসিফিকেশন এর মধ্যে ক্যামেরা সেকশনে দেখতে পাই f/1.6, f/1.8, f/2.0, f/2.2 ইত্যাদি লেখা থাকে। এটাই মূলত ওই ক্যামেরার অ্যাপারচার নির্দেশ করে। f/ এরপর যে সংখ্যা থাকে তার মান যত কম হবে ততো বেশি পরিমাণে আলো লেন্স এর ভিতর দিয়ে ক্যামেরার সেন্সর ঢুকতে পারবে। এতে রাতের বেলায় অর্থাৎ লো লাইটিং কন্ডিশনে সেন্সর বেশি পরিমাণে আলো ক্যাপচার করতে পারবে। সুতরাং লো লাইটে ভালো পারফরম্যান্স পাওয়ার জন্য অ্যাপারচার এর বিষয়টা মাথায় রেখে স্মার্টফোন কিনবেন।

সব সময় চেষ্টা করবেন কম অ্যাপারচার যুক্ত ক্যামেরার ফোন কেনার।

Camera2API এর গুরুত্ব

একজন ফটোগ্রাফি প্রেমী ব্যাক্তির কাছে ম্যানুয়াল ক্যামেরা ফিচার ব্যবহার করা প্রায় নিত্যদিনের কাজ। ফোনের ক্যামেরার প্র মুড বা ম্যানুয়াল মুড অথবা এক্সপার্ট মুড ব্যবহার করে অসাধারণ কিছু ছবি তুলা সম্ভব। এই ম্যানুয়াল মুড এর বেশি ব্যবহার করা হয় নাইট ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে। সাটার স্পিড বারিয়ে পাশাপাশি ISO কে কন্ট্রোল করে রাতের বেলায় অনেকটা উজ্জ্বল ছবি ক্যাপচার করা সম্ভব। এসব কিছুই সম্ভব Camera2API এর মাধ্যমে। Camera2API এমন একটা ফিচার যার মাধ্যমে ম্যানুয়ালি সাটার স্পীড, ISO, ফোকাস, White Balance ইত্যাদি ম্যানুয়ালি কন্ট্রোল করা যায়। বর্তমান সময়ে অধিকাংশ ফোনেই এই Camera2API এর সাপোর্ট থাকে। তবে কিছু কম্পানি এখনও আছে যারা তাদের ফোনে এই Camera2API এর সাপোর্ট দেয় না। অর্থাৎ এদের ফোন দিয়ে আপনি প্র মুডে খুব লিমিটেড ফিচার ব্যবহার করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে আপনি ম্যানুয়াল মুডে ছবি তুলার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন।

শেষ কথা

সেক্ষেত্রে আপনার মুল চাহিদা যদি ফটোগ্রাফি হয় সেক্ষেত্রে উপরের দেওয়া বিষয়গুলো মাথায় রেখে স্মার্টফোন কিনলে আপনি আপনার জন্য সেরা ফোনটি বেছে নিতে পারবেন।