আমরা যখন কোন স্মার্টফোনের ক্যামেরার রিভিউ দেখি তখন সেখানে প্রায়ই শুনে থাকি DXOMARK স্কোরের কথা। বলা হয় স্মার্টফোনটি DXOMARK এ কত স্কোর করেছে। যে ফোনের স্কোর যত বেশি হয় সেই ফোনের ক্যামেরা কে ততো ভালো মানা হয়। অনেকে তো আবার সেই স্কোরের উপর ডিপেন্ড করে ক্যামেরা রিভিউ করে। কিন্তু আমরা অনেকেই এই DXOMARK সম্পর্কে জানিনা না। না জানার পরেও এর স্কোর উপর অনেক সময় ভরসা করি। যেহেতু অনেক রিভিউয়ার ক্যামেরা রিভিউতে এই DXOMARK এর স্কোর উল্লেখ করে।
সেক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই জানা উচিত DXOMARK কি? পাশাপাশি আমাদের জানা উচিত, এই DXOMARK কিভাবে কাজ করে? শুধুমাত্র তখনই আমরা বুঝতে পারবো, এই DXOMARK এর উপর আমাদের কতটা নির্ভর করা উচিত। তো চলুন শুরুতেই DXOMARK এর পরিচয় দিয়ে শুরু করা যাক।
DXOMARK কি?
DXOMARK হলো এমন একটি কোম্পানি বা ওয়েবসাইট যারা বিভিন্ন অবস্থায় স্মার্টফোনের ক্যামেরা পারফরমেন্সের উপর ভিত্তি করে স্কোর করে। উইকিপিডিয়ার মতে, DXOMARK হলো এমন একটি কমার্শিয়াল ওয়েবসাইটে যারা স্মার্টফোন, লেন্স ও ক্যামেরাকে বিজ্ঞানভিত্তিক উপায় বিচার করে। অর্থাৎ DXOMARK সাধারণত ক্যামেরা ও ক্যামেরা সম্পর্কিত বিভিন্ন এক্সোসরিস কে তাদের নিজস্ব কিছু প্যারামিটার এর উপর নির্ভর করে টেস্ট করে। এবং ওই প্যারামিটারগুলো থেকে প্রাপ্ত স্কোরগুলোকে গড় করে একটি নির্দিষ্ট রেটিং বা স্কোর প্রদান করে।
DXOMARK 2008 সালে লঞ্চ করা হয় এবং এর হেডকোয়ার্টার ফ্রান্সে অবস্থিত। এই গেল DXOMARK এর সাধারণ পরিচয়। এবার আসি আমাদের কাঙ্ক্ষিত সেই আলোচনায় যেখানে DXOMARK কিভাবে কাজ করে সেই সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আপনাদের সাথে শেয়ার করতে যাচ্ছি।
DXOMARK কিভাবে কাজ করে?
DXOMARK মূলত বিভিন্ন কন্ডিশনে স্মার্টফোনের ক্যামেরা কেমন পারফরম্যান্স করে সেটা বিচার করে। এরা মূলত বিভিন্ন কন্ডিশন বেশ কিছু ছবি তুলে ও ভিডিওগ্রাফি করে। এবং সেটাকে বিভিন্ন প্যারামিটারের উপর টেস্ট করে। DXOMARK এর মতে তারা প্রতিটি স্মার্টফোনের ক্ষেত্রে প্রায় 1500 এর মত ছবি ক্যাপচার করে এবং ডজনখানেক ভিডিও রেকর্ড করে। ছবিগুলো তোলা হয় প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার দ্বারা এই ছবি ও ভিডিও গুলো কে বেশকিছু প্যারামিটারে পরীক্ষা করে এবং তার থেকে প্রাপ্ত রেজাল্ট কম্বাইন বা গড় করে সেটাকে বেঞ্চDXOMARK হিসেবে প্রকাশ করে।
DXOMARK এর স্কোর কতটা নির্ভরযোগ্য সেটা বুঝতে আমাদের এই প্যারামিটার গুলো সম্পর্কে জানতে হবে। এগুলো কিভাবে কাজ করে তা জানালে আমরা খুব সহজেই বুঝতে পারব সেরা ক্যামেরা ফোন কিভাবে নির্বাচন করতে হয়।
DXOMARK এ কেনো ফটো এবং ভিডিও পৃথকভাবে পরীক্ষা করা?
বিভিন্ন পরিস্থিতিতে স্মার্টফোনের ক্যামেরা কতটা ভালো কাজ করে সেটা পরীক্ষা করার জন্যই ফটো এবং ভিডিও পৃথকভাবে পরীক্ষা করা হয়। একটি ফটো তোলার পরে সেটা প্রসেস হতে কিছুটা টাইম নিতে পারে। কিন্তু এটা ভিডিওগ্রাফির ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। কারণ ভিডিওগ্রাফির ক্ষেত্রে যদি 30fps এর ভিডিও করা হয় সেক্ষেত্রে প্রতিটা ছবি এক সেকেন্ডের মধ্যে তুলে এটাকে ওই ১ সেকেন্ডের মধ্যেই প্রসেস করতে হয়। যেটা ভালোভাবে সম্ভব হয়ে ওঠেনা। অর্থাৎ একটি স্থির ছবিতে যতটা ভালো রেজাল্ট পাওয়া যায় ভিডিওগ্রাফি তে ততটা ভালো রেজাল্ট পাওয়া যায় না। তবে এটা অনেকটা প্রসেসর এর উপর নির্ভর করে। প্রসেসর পাওয়ারফুল হলে সেটা ঐ কম সময়ের মধ্যেই ইমেজকে ভালোভাবে প্রসেস করতে পারে। সেক্ষেত্রে স্থির ছবির মতোই ভিডি ভিডিওগ্রাফিতেও ভালো পারফরম্যান্স পাওয়া সম্ভব।
DXOMARK টেস্টিং এর সময় স্থির ছবি ও ভিডিওকে বেশকিছু প্যারামিটারে টেস্ট করে। যেমন:
- এক্সপোজার
- কনট্রাস্ট
- কালার
- অটোফোকাস
- টেক্সচার ও নয়েজ
- আর্টিফাক্ট বা কৃত্রিম বস্তু
- ফ্লাশ
- ভিডিওর ক্ষেত্রে স্ট্যাবিলাইজেশন
- জুম
- বোকেহ্
এগুলোকে DXOMARK এর ভাষায় সাব স্কোর (sub-score) বলা হয়। এই সবগুলো পরীক্ষা করা হয় ভিন্ন ভিন্ন লাইটিং কন্ডিশনে তোলা ছবি থেকে। সেটা হতে পারে ইনডোর লাইটিং বা আউটডোর লাইটিং কন্ডিশন।
এক্সপোজার এবং কনট্রাস্ট
এক্সপোজার ছবির বিভিন্ন অংশে আলোর পরিমাণ নির্দেশ করে। যেমন সাবজেক্টের উপর কতটা আলো থাকবে কিংবা ব্যাকগ্রাউন্ডে কতটা থাকবে। এইসবই কন্ট্রোল করে এক্সপোজার। ডায়নামিক রেঞ্জ হলো ছবিতে অতিরিক্ত উজ্জল অথবা তুলনামূলক অন্ধকার অংশের আলো প্রয়োজনমতো বাড়িয়ে বা কমিয়ে ওই অংশের ডিটেলস বৃদ্ধি করা।
কনট্রাস্ট হলো ছবির কালার বা টোন। একটি ছবির মধ্যে সবথেকে আলোকিত অংশ এবং সব থেকে অন্ধকার অংশের অনুপাত হল কনট্রাস্ট।
আমরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন লাইটিং কন্ডিশনের ছবি তুলি। সেখানে অনেক সময় ছবির কিছু অংশ অত্যাধিক আলোকিত থাকে। যেমন সূর্যকে পিছনে রেখে আমার যদি সেলফি তুলি সে ক্ষেত্রে দেখা যায় সূর্যের অত্যাধিক আলোকে কন্ট্রোল করতে গিয়ে ক্যামেরা আমাদের ফেস কে কালো করে দেয়। এমনটা হয় দুর্বল ডায়নামিক রেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট এর কারণে। DXOMARK ক্যামেরার এই এক্সপোজার অথবা ডায়নামিক রেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট এর উপর স্কোর করে।
কালার অ্যাকুরেসি
স্মার্টফোন থেকে যখন ছবি তোলা হয় তখন স্মার্টফোন বিভিন্ন রঙের আলো ক্যাপচার করে। ক্যামেরার সেন্সর মূলত আলো থেকে আসা বিভিন্ন রঙের তরঙ্গ গ্রহণ করে এবং প্রতিটা রঙের জন্য আলাদা আলাদা সিগনাল আইএসপি কে পাঠায়। ইমেজ প্রসেসর সেই অনুযায়ী একটি ইমেজ ছবি তৈরি করে। কিন্তু একটি ক্যামেরা থেকে তোলা ছবির রং অনেক সময় আমাদের চোখে দেখা রঙের সাথে মিলে না। DXOMARK মূলত ক্যামেরা থেকে তোলা ছবি এর রং বা কালার বাস্তবে চোখে দেখা রংয়ের কতটুকু কাছাকাছি রেজাল্ট দেয় সেটা পরিমাপ করে। একেই বলা হয় কালার অ্যাকুরেসি।
অনেক সময় স্মার্টফোনের ক্যামেরা ছবিকে সুন্দর করতে গিয়ে কালার বুস্ট করে দেয়। অথবা অপটিমাইজেশনের ভুলের কারণে অনেক সময় সঠিক কালার ছবি থেকে পাওয়া যায় না। যেমন অনেক সময় অরেঞ্জ বা কমলা রংকে হলুদ করে দেয়।
DXOMARK টেস্টিং এর সময় বিভিন্ন অবস্থান থেকে ছবি তুলে সেটাকে ইন্ডাস্ট্রি স্ট্যান্ডার্ড কালার চার্ট এর সাথে তুলনা করে স্কোরিং করে।
অটো ফোকাস
এই প্যারামিটার বিভিন্ন লাইটিং কন্ডিশনে একটি স্মার্টফোন কত দ্রুত এবং সঠিকভাবে কোনো বস্তুর উপর ফোকাস আনতে পারে সেটা পরিমাপ করে।
আমরা যখন এমন কোনো বস্তুর ছবি তুলি যেটা প্রতি মুহূর্তে তাঁর অবস্থান পরিবর্তন করে তখন এই অটোফোকাস কার্যকরী হয়। যেমন কোন প্রজাপতির ছবি তোলার সময় প্রজাপতিটি অনবরত নড়াচড়া করতে থাকে। তখন অটো ফোকাসিং ভালো থাকলে প্রজাপতিটি নাড়াচাড়া করলেও আপনি ক্লিয়ার ছবি তুলতে পারবেন। বাস্তব জীবনে এমন অনেক সময় ছবি তুলতে হয় যখন এই auto-focus কাজে দেয়। যেমন কোনো স্পোর্টসের ছবি তুলতে গেলে, কোন বাচ্চাদের খেলাধুলার ছবি তুলতে গেলে। অটোফোকাস শুধুমাত্র স্থির ছবির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ না এটি ভিডিওগ্রাফির ক্ষেত্রেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
টেক্সচার এবং নয়েজ
টেক্সচার হলো কোন ছবির মধ্যে বিভিন্ন বস্তুর ডিটেল। টেক্সচার বলতে কোন সমান্তরাল তলের উপরে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ডিটেলস বুঝায়। একটি ক্যামেরা সেন্সর কতটা বেশি পরিমাণে ডিটেল গ্রহণ করতে পারে এবং সফটওয়্যার সেই ডিটেইল কে কত ভালো প্রসেস করতে পারে সেটাই DXOMARK পরীক্ষা করে। অনেক সময় ছবিতে টেক্সচার আনতে গিয়ে ছবিতে নয়েজ চলে আসে। ক্যামেরা সফটওয়্যার অ্যালগরিদম ভালো হলে সেটা ছবি থেকে নয়েজ রিমুভ করে ভালো মানের টেক্সচার আনতে পারে।
রাতের বা কম আলোয় ফটোগ্রাফিতে বেশিরভাগ সময়ে নয়েজ এর পরিমাণ বেশি থাকে। যেমন নিচের ছবি দুটি লক্ষ করলে দেখা যাবে বামপাশের ছবিতে নয়েজের পরিমাণ বেশি এবং ডানপাশের ছবিতে নয়েজের পরিমাণ কম এটি মূলত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সফটওয়্যার অ্যালগরিদম এর জন্য। ডানপাশের ছবিটি নয়েজ কম কারণ এর সফটওয়্যার নয়েজ খুব ভালোভাবে দূর করতে পেরেছে।
ছবিতে নয়েজ এবং ডিটেইল টেক্সচার এর সঠিক নিয়ন্ত্রণকে পরীক্ষা করে DXOMARK। যে ফোনের ক্যামেরা কম নয়েজ এর সাথে ভালো ডিটেইল ছবি দিতে পারবে সেটি অবশ্যই বেশি স্কোর পাবে।
ফ্লাশ (Flash)
সাধারণত কম আলোতে কাছের কোন বস্তুর ছবি তুলতে ফ্লাশ কার্যকরী হয়। কিন্তু অনেক সময় ফ্লাশ লাইটের আলো ছবির কালার পরিবর্তন করে দেয়। ফলে ছবিটি অস্বাভাবিক লাগে। DXOMARK ফ্লাশ ছাড়া তোলা ছবি এবং ফ্লাশ চালু করে তোলা ছবির মধ্যে পার্থক্য খুঁজে এবং ফ্লাশ কতটা কার্যকর তা পরিমাপ করে।
জুম (Zoom)
দূরবর্তী কোনো বস্তুর ছবি তোলার ক্ষেত্রে জুম ব্যবহার করা হয়। কিন্তু অধিকাংশ ফোন নরমাল মুডে তোলা ছবিকে ক্রপ এবং রিসাইজ করে করে, যাকে ডিজিটাল জুম বলা হয়। কিন্তু ডিজিটাল জুম এর ক্ষেত্রে ছবির কোয়ালিটি খারাপ হয়ে যায়, ডিটেইল কমে যায়। কিন্তু বর্তমান সময়ে ফ্ল্যাগশিপ স্মার্টফোনগুলোতে 2X থেকে 10X পর্যন্ত অপটিক্যাল জুম ব্যবহার করছে। যার ফলে জুম করার পরেও ছবিতে ভালো ডিটেইলস পাওয়া যাচ্ছে।
DXOMARK ডিজিটাল জুম এবং অপটিক্যাল জুম উভয়কেই একই ভাবে পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে নির্দিষ্ট পর্যায়ে জুম করার পর ডিজিটাল এবং অপটিক্যাল জুম এর মধ্যে কোনটার ছবি ছবি কতটা ভালো আসে।
ইমেজ স্ট্যাবলাইজেশন
ইমেজ স্ট্যাবলাইজেশন ভিডিওগ্রাফির ক্ষেত্রে বেশি ব্যবহার করা হয়। আমরা যখন কোন কিছুর ভিডিও করি তখন আমাদের হাত নাড়াচাড়া করে। এতে ভিডিও ফুটেজ সেকি হয়ে যায়। এই সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য 2 টি পদ্ধতির ব্যবহার করা হয়
- EIS বা Electronic Image Stablization– EIS এর ক্ষেত্রে ভিডিও এর প্রতিটা ফ্রেম থেকে কিছুটা crop করে পরবর্তী ফ্রেম এর সাথে ম্যাচ করে এমন অংশ এর সাথে জুড়ে দেয়। এভাবে ফ্রেম crop করে ভিডিও এর সেকি ভাব দূর করে stable ফুটেজ তৈরি করে। পুরোটাই হয় সফটওয়ার এর সাহায্যে তাই একে Electronic Image Stablization বলা হয়।
- OIS বা Optical Image Stablization– OIS এর ক্ষেত্রে ক্যামেরা এর hardware বা যন্ত্রাংশে এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় যাতে ক্যামেরা সেন্সর নাড়াচাড়া করতে পারে। ভিডিওগ্রাফি করার সময়ে আমাদের হাতের মুভমেন্ট এর সাথে তাল মিলিয়ে ক্যামেরা সেন্সর নাড়াচাড়া করে। যেমন আমাদের হাত উপরের দিকে মুভ করলে সেন্সর নিচের দিকে মুভ করে। অর্থাৎ বিপরীত দিকে মুভ করে। ফলে একটি স্থির ভিডিও পাওয়া যায়। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় উন্নতমানের DSLR ক্যামেরায়। কিন্তু বর্তমানে দামী স্মার্টফোনেও এই OIS ব্যবহার করা হয়। যেহেতু ভিডিও stable করার জন্য পুরো লেন্স বা সেন্সর কাজে লাগে তাই একে Optical Image Stablization বলা হয়।
DXOMark এর আরো 2 টি প্যারামিটার বা সাব স্কোর আছে যেগুলো হল Artifact ও Bokeh।
এভাবেই DXOMARK প্রতিটা স্মার্টফোনের ক্যামেরাকে টেস্ট করে। প্রতিটা প্যারামিটার বা সাব স্কোর থেকে প্রাপ্ত স্কোর এর গড় বের করে সেটা চূড়ান্ত স্কোর হিসেবে ঘোষণা করে। DXOMARK এর এই প্যারামিটার বা সাব স্কোর গুলো বাস্তব জীবনেও একটি ভালো ফটো পরীক্ষা করতে সাহায্য করে। এগুলো সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে আমরা খুব সহজেই বিভিন্ন বাজেটে সেরা ক্যামেরা ফোন খুঁজে পেতে পারি।
2 thoughts on “DXOMARK কি? গুজব নাকি সত্যি?”